এক নজরে
ভাবুন তো, আপনি পৃথিবী থেকে ৪০০ কিলোমিটার ওপরে ভাসছেন, যেখানে দিন-রাতের পার্থক্য শুধু সূর্যোদয় নয়, সময়ের হিসেবও বদলে যায়। এই আশ্চর্য জায়গাটির নাম আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন (ISS)—একটি চলমান ল্যাব, যেখানে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও আন্তর্জাতিক বন্ধুত্বের এক অভাবনীয় মিলন ঘটে। আর ঠিক এই স্থানেই সম্প্রতি পা রেখেছেন একজন ভারতীয় বীর—গ্রুপ ক্যাপ্টেন শুভাংশু শুক্লা। তিনি শুধু একজন নভোচারী নন, বরং লাখো তরুণের অনুপ্রেরণা, ভারতের মহাকাশ গবেষণার নতুন অধ্যায় শুরু করার পথিকৃৎ। ISS কী? ISS কীভাবে কাজ করে? শুক্লার মহাকাশযাত্রা কেমন ছিল? কীভাবে তিনি বৈজ্ঞানিক ও সাংস্কৃতিক পরিচয়ে ভারতের পতাকা পৃথিবীর বাইরে পৌঁছে দিলেন? বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক।
ISS- International Space Station
ISS এর পুরো কথা হল আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন, যা পৃথিবীর নিম্ন কক্ষপথে (Low Earth Orbit) ঘুরতে থাকে। এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র (NASA), রাশিয়া (Roscosmos), কানাডা (CSA), জাপান (JAXA) ও ইউরোপীয় মহাকাশ সংস্থা (ESA)–এর যুগান্তকারী সহযোগিতায় ১৯৯৮ সালে নির্মাণ শুরু হয়। এটি মানব বসবাসযোগ্য একটি গবেষণা ল্যাবরেটরি, যেখানে মাইক্রোগ্র্যাভিটি পরিস্থিতিতে বিজ্ঞানের বিস্ময়কর গবেষণা করা হয়।
এখানে কী ধরনের বৈজ্ঞানিক গবেষণা হয়?
রসায়ন, জীববিজ্ঞান, ফিজিক্স, পৃথিবীর পর্যবেক্ষণ, উদ্ভিদবিজ্ঞান—অনেক ক্ষেত্ৰেই আন্তর্জাতিক গবেষণা কেন্দ্রে গবেষণা চলে। উদাহরণস্বরূপ: মাইক্রোঅ্যালগি গবেষণা, বোন হেলথ ও রেডিয়েশন স্টাডি, আলগােথিনার বৃদ্ধি প্রক্রিয়া, ও জৈব–কাঁচামালের গবেষণা ইত্যাদি নিয়ে বিভিন্ন সময়ে বিশেষজ্ঞ গবেষকরা আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশনে গিয়ে গবেষণা করে থাকেন।
শুভাংশু শুক্লা কে?
শুভাংশু শুক্লা লখনউতে জন্মগ্রহণ করেন (১০ অক্টোবর ১৯৮৫)। তিনি IAF টেস্ট-পাইলট ও ISRO–র গগানযাত্রী হিসেবে নির্বাচিত হন। ২০১৯ সালে গ্যাগানযান প্রথম গ্রুপের একজন হিসেবে মনোনীত হন । তিনি Axiom Mission 4 (Ax‑4)–এর মিশন পাইলট হিসেবে নির্বাচিত হন, এবং SpaceX Crew Dragon–এ ২৫ জুন ২০২৫–এ উৎক্ষেপিত হয়ে ISS–এ যান । তিনি ISS– তে প্রথম ভারতীয় নভোচারী হিসাবে পা রাখেন শুভাংশ শুক্লা। ভারতের রাকেশ শর্মার পর, শুভাংশু সুখলা প্রথম, যিনি মহাকাশ ভ্রমণ করলেন। যদিও নভোচারী রাকেশ শর্মা ISS–এ যাননি, তিনি Salyut স্টেশনে গিয়েছিলেন।
আরও পড়ুনঃ ভারতের প্রধানমন্ত্রী তালিকা, দেখে নিন একনজরে
তার মিশন কতটা সফল ও তা কেন গুরুত্বপূর্ণ?
মহাকাশচারী শুভাংশু শুক্লার মোট ১৮ দিনের এই যাত্রা ছিল মূলত সামরিক, বৈজ্ঞানিক ও গবেষণা প্রয়োজনে। এই যাত্রায় মহাকাশচারী সফলভাবে ৬০০ কেজিরও বেশি ব্যবহারযোগ্য বৈজ্ঞানিক নমুনা সহ ফেরত এসেছেন। যাত্রাপথে তিনি ISS–এ ভারতীয় পতাকা বহন করে গীত “Jai Hind, Jai Bharat!” ঘোষণা করেন, যা জাতীয় গর্বের প্রতীক হয়ে ওঠে।
আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে মহাকাশচারীরা কিভাবে ঘুমান?
মহাকাশে কোনো অভিকর্ষ বল (gravity) না থাকায় বিছানা থেকে পড়ে যাওয়ার কোনো ভয় থাকে না। মহাকাশচারীরা সাধারণত ঘুমানোর সময় ঘুমের ব্যাগে ঢুকে স্টেশনের দেয়ালের সঙ্গে সেটি বেঁধে রাখেন। এটি তাদের শরীরকে ভেসে যাওয়া থেকে রক্ষা করে।
শুভাংশু শুক্লা কিভাবে মহাকাশচারী হিসেবে নির্বাচন হন?
তিনি ছিলেন একজন গবেষক ও বিমান প্রকৌশলী। বৈজ্ঞানিক গবেষণার পাশাপাশি শারীরিক ও মানসিক পরীক্ষায় সফলভাবে উত্তীর্ণ হওয়ার ফলে তিনি নির্বাচিত হন। এটি মহাকাশচারী হবার পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ।
আরও পড়ুনঃ কলকাতার ট্রামের ইতিহাস, জানুন কলকাতা ট্রামের অজানা তথ্য
আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে দিনে কতবার সূর্যোদয় দেখা যায়?
ISS প্রতি ৯০ মিনিটে একবার পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে, ফলে এক দিনে (২৪ ঘণ্টায়) তারা প্রায় ১৬ বার সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখতে পান। এটি পৃথিবীর চেয়ে একেবারেই ভিন্ন অভিজ্ঞতা।
শুভাংশু শুক্লার মতে মহাকাশে প্রথম দিনটা কেমন ছিল?
তিনি বলেছিলেন, প্রথম দিনে দেহের ভারহীনতা সামাল দিতে সমস্যা হয়েছিল। মাথা ঘোরা, বমি বোধ এবং ভারসাম্যহীনতা ছিল প্রাথমিক কিছু সমস্যা। এটি মহাকাশে acclimatization-এর অংশ।
মহাকাশে খাদ্য গ্রহণের অভিজ্ঞতা কেমন হয়?
খাদ্য সাধারণত প্যাকেটজাত এবং জেলি বা গুঁড়ো রূপে থাকে। খোলা অবস্থায় ভেসে যাওয়ার আশঙ্কা থাকায় চামচ বা ফর্ক ব্যবহার কঠিন। তাই খাদ্য বিশেষ কন্টেইনার থেকে চুষে খেতে হয়।
মহাকাশে শরীরের পেশী দুর্বল হয়ে পড়ে কেন?
অভিকর্ষ শক্তির অভাবে পেশিগুলির ওপর চাপ পড়ে না, ফলে ব্যবহার না হওয়ায় সেগুলি দুর্বল হয়ে পড়ে। তাই মহাকাশচারীরা নিয়মিত ব্যায়াম করেন যাতে পেশী ও হাড় শক্ত থাকে।
মহাকাশ থেকে পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগ কিভাবে হয়?
ISS পৃথিবীর সঙ্গে রেডিও তরঙ্গ, স্যাটেলাইট এবং নেটওয়ার্কের মাধ্যমে সংযুক্ত থাকে। ভিডিও কল, ইমেল এবং ডেটা ট্রান্সফার করে বিজ্ঞানীরা পৃথিবীর সাথে যোগাযোগ রাখেন। শুভাংশু তাঁর পরিবারের সঙ্গে মাঝে মাঝে ভিডিও কল করতেন।
মহাকাশে সময় অনুভূতি কীভাবে প্রভাবিত হয়?
সূর্যোদয়-সূর্যাস্তের ঘন ঘন পরিবর্তনের কারণে দেহের বায়োলজিক্যাল ক্লক বিভ্রান্ত হতে পারে। এটি ঘুম ও কাজের সময়ের ওপর প্রভাব ফেলে। তাই ISS-এ সময় অনুযায়ী সূচি মেনে কাজ করতে হয়।
শুভাংশু কিভাবে মহাকাশে তার গবেষণার কাজ করতেন?
তিনি মূলত মাইক্রোগ্র্যাভিটির প্রভাব নিয়ে গবেষণা করতেন। তার গবেষণায় ছিল জীববিজ্ঞান ও পদার্থবিজ্ঞানের নানা পরীক্ষা, যেগুলি পৃথিবীতে করা সম্ভব নয়।
শুভাংশু কীভাবে মহাকাশে মানসিক চাপ সামাল দিতেন?
মহাকাশে দীর্ঘ সময় বিচ্ছিন্ন থাকা কঠিন। তিনি নিয়মিত মেডিটেশন, সংগীত শোনা এবং পৃথিবীর ছবি দেখা ইত্যাদির মাধ্যমে নিজেকে মানসিকভাবে স্থির রাখতেন। মহাকাশযাত্রা চলাকালীন মনোসংযোগ রক্ষা করাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে দুর্ঘটনার প্রস্তুতি কেমন থাকে?
ISS-এ আগুন, বায়ু চাপ হ্রাস, কিংবা কক্ষপথে বস্তু আঘাত করলে করণীয় প্রস্তুতি রাখা হয়। মহাকাশচারীরা নিয়মিত সিমুলেশন ট্রেনিং করে থাকেন। শুভাংশু একবার অক্সিজেন লিক হওয়া পরিস্থিতিরও অভিজ্ঞতা অর্জন করেন।
ISS-এ বিজ্ঞানীরা কিভাবে শরীরের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করেন?
নিয়মিতভাবে রক্তচাপ, হার্টরেট, দৃষ্টিশক্তি ইত্যাদি চেক করা হয়। পরীক্ষার ফলাফল পৃথিবীতে পাঠানো হয় এবং ডাক্তাররা সেগুলো পর্যালোচনা করেন। এটি দীর্ঘ মেয়াদে মহাকাশে থাকার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
.মহাকাশ থেকে পৃথিবীকে দেখা কেমন অনুভূতির সৃষ্টি করে? শুভাংশুর অভিজ্ঞতা কী ছিল?
শুভাংশু বলেন, পৃথিবীকে ছোট একটি নীল-সবুজ গোলক রূপে দেখা এক অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা। এটা মানুষকে এক গভীর ভাবনা দেয় “আমরা সবাই একটি গ্রহের বাসিন্দা”। এই দৃষ্টিভঙ্গি অনেককেই আরও মানবিক ও পরিবেশ সচেতন করে তোলে।
গ্রুপ ক্যাপ্টেন শুভাংশু শুক্লার এই মহাকাশ যাত্রা নিছক একটি বৈজ্ঞানিক মিশন নয়—এটি একটি স্বপ্নপূরণের কাহিনি, একটি দেশের আত্মবিশ্বাসের বহিঃপ্রকাশ। যখন তিনি ISS-এ দাঁড়িয়ে “জয় হিন্দ, জয় ভারত” উচ্চারণ করলেন, তখন শুধু শব্দ নয়, তা ছিল ১৪০ কোটির আবেগ, গর্ব, এবং ভবিষ্যতের সম্ভাবনার প্রতিধ্বনি। তাঁর মিশনের সফলতা আমাদের শেখায়—স্বপ্ন, যদি পরিশ্রম ও সাহসে ভরপুর হয়, তবে তা মহাকাশেও পৌঁছাতে পারে। এই গল্প শুধু মহাকাশযাত্রার নয়; এটি আমাদের নিজ নিজ জীবনের ছোট-বড় স্বপ্ন পূরণের উৎসাহ। শুভাংশু শুক্লা শুধু মহাকাশে যাননি, তিনি আমাদের কল্পনা, বিজ্ঞান ও আত্মবিশ্বাসকে নতুন দিগন্তে পৌঁছে দিয়েছেন।